জুনেদ আহমদ চৌধুরী
কবি বলেছিলেন-একবার না পারিলে দেখো শতবার। তার এক জলন্ত উদাহরণ সিলেটের জকিগঞ্জের কসকনকপুর ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান জনাব আব্দুস সাত্তার মঈন। চার বার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়ে এবার তিনি চেয়ারম্যানের পদে আসীন হলেন। স্থানীয় অনেক মারপেঁচে তিনি জয়ী হতে পারবেন না জেনেও তিনি নির্বাচন থেকে কখনো সরে যাননি। প্রতিবার নির্বাচনে লড়েছেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে এবং প্রতিবার তিনি প্রায় দুই হাজারের বেশি ভোটও পেতেন।অনেক আগেই হয়তো তিনি জয়ী হতেন যদি তাঁর অর্থের জোর বেশি থাকত। কারণ এই ইউনিয়নে নির্বাচন মানেই যেন টাকার খেলা।
গেল সোমবার (১৭ জুলাই) কসকনকপুর ইউনিয়নে উপনির্বাচন অনুষ্টিত হয়েছে। বিশাল প্রতিকুলতার মধ্যে ৪১৫৭ ভোট পেয়ে জনাব আব্দুস সাত্তার মঈন বিজয় লাভ করেছেন। তার প্রাপ্ত ভোট নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে হাজারেরও বেশি ছিল। তবে তিনি এখন আর তাঁর প্রাপ্ত ভোটারের চেয়ারম্যান নন।চেয়ারম্যান পুরো ইউনিয়নের ১৫ হাজার ভোটারের।
জনগণ তার প্রতি কি পরিমাণ ভালোবাসা দেখিয়েছে যা এই ইউনিয়ন তথা গোটা জকিগঞ্জের মানুষ কেবলই বলতে পারবেন। পিছিয়ে পড়া এ ইউনিয়নের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছে আশাকরি তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করবেন। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তাঁর মুখে উল্লোসিত দেখা যায়নি, তাঁর মুখে বারবার মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ের বাক্য আমরা শুনতে পেয়েছিলাম। বিজয়ের পর রেজাল্ট শীট নিয়ে তিনি যখন মুনশিবাজারে ফিরেছিলেন তাঁকে একটি উচু চেয়ার বসার জন্য দিয়েছিল জনগন। কিন্তু তিনি তখন সেই চেয়ারে বসেননি। সেই চেয়ার তিনি দিয়েছিলেন উপস্থিত আরেক মুরব্বী ও গুনিজনকে। প্রথম ধাপেই এগুলো ভালো লক্ষণ নয় কি?
মানুষের ভালোবাসার দু চারটি উদাহরণ দেই। এই বর্ষা মৌসুমে কাঁদার মধ্যেও যখন ছোট বাচ্ছা থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও তাঁর নির্বাচনে দিনরাত কাজ করতে দেখেছে আপামর মানুষ। তিনি যাতে বিজয়ী হন-ইউনিয়ন তথা উপজেলার অজস্র মানুষ নানাভাবে তাঁকে সাহায্য করেছে। অন্য ইউনিয়নের কত না চেনা, অজানা মানুষ তাঁর বিজয় নিশ্চিতে ইউনিয়নে এসে কাজ করতে নিজ চোখে দেখেছি। অথচ প্রার্থী তাদেরকে চিনেনই না। কত মানুষ চাঁদা তুলে তাঁর নির্বাচনী খরচ চালিয়েছে সেটি ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ।
আমার এক মামাতো বোন আইয়র গ্রামেরই বাসিন্দা। সে ক্লাশ নাইনে পড়ে। তিনি যাতে বিজয়ী হন সেজন্য সে মসজিদে ১০ টাকা আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়েছে। ১০ মাসের শিশু থাকা অবস্থায় বাবা হারানো এই মেয়েটির দোয়া আল্লাহর কাছে বৃথা যায়নি। আমার মা-নানী আরেক খালা দিনরাত আল্লাহর কাছে হাত তুললেই দোয়া করেছিলেন অবিরত। শুধু কি তারাই? না, শতশত মানুষ মোটরসাইকেল মার্কার প্রার্থী মঈন চাচার জন্য নফল নামাজ থেকে শুরু করে যে যা পেরেছেন সেভাবেই আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। সকলের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন।
আরেকটি উদাহরণ দেই-আমার নিজ সেন্টার হাজীগঞ্জ সেন্টারে সকালে যখন গেলাম বেলা বাড়ার সাথে সাথে তখন দেখি গ্রামের পরিচিত অনেক মানুষ ভোট দিতে এসেছেন সিলেট শহর কিংবা নানা জায়গা থেকে। অথচ তাদের অনেককেই আমার বলাও হয়নি ভোট দিতে আসিয়েন। তারা এসেছিলে তাদের নিজ উদ্যোগে। তাদের পরিবার পরিজন বাড়িতে না থাকায় ভোট দিয়েই আবার ফিরে যেতে দেখেছি নিজের ঠিকানায়। মানুষের এত এত ভালোবাসা কেন ছিল তারও অনেক কারণ এই ইউনিয়নের মানুষই জানেন। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পুঞ্জিবুত থাকতে থাকতে এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
যাইহোক-আসি মূল কথায়। নির্বাচন শেষ হয়েছে আমরা সকল এই ইউনিয়নের মানুষ। নির্বাচনের সকল ভেদাভেদ ভূলে ইউনিয়নের উন্নয়নে সকলে এক কাতারে দাড়াই। কারণ সকল এক না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কাজ পাগল মঈন চাচা ইনশা আল্লাহ কিছু হলেও একটা কিছু করতে পারবেন। নির্বাচনের পরের দিনইই গতকাল তিনি কয়েকজন মেম্বার নিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করেছেন। কথা বলেছেন-কাজ কিভাবে করা যায়। নির্বাচনে আরও যে ৩ জন প্রার্থী ছিলেন তাঁদেরও যেকোন সু পরামর্শ নেবেন বলে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। কোন কাজ করার আগে তাঁদেরকে চিঠি দিয়ে অবগত করবেন বলেও জানিয়েছেন। মেম্বার বাদে প্রতিটি এলাকার উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা মানুষেরও পরামর্শ নেবেন বলে তিনি লাইভে ঘোষণা দিয়েছেন। উন্নয়ন নিয়ে আমি নগণ্য মানুষের যদি কোন কাজে লাগে আমাকে কাজে লাগালে আমি সামনের সারিথে থাকব ইনশা আল্লাহ।
নব নিরবাচিত চেয়ারম্যানের সময় মাত্র ৩ বছরের সামান্য বেশি। এই কম সময়ে পাহাড়ের মত সমস্যাওয়ালা এ ইউনিয়ের সকল সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। গাছ রোপন করলে ফল পাওয়া যায় কয়েক বছর পরে। তাই মাস্টারপ্ল্যান করে ধীরে ধীরে এগুতে থাকলে তাঁর হাতে হোক আর অন্যের হাতে হোক একদিন মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। তবে এ ইউনিয়নের কিছু এলাকা অন্যান্য এলাকার চেয়ে বিগত দিনে কিছু বেশি উন্নয়ন হয়েছে। এবার পিছিয়ে পড়া ওয়ার্ড যেমন ৫/৬সহ আরো যে গ্রামগুলো রয়েছে এসব এলাকা চিহ্নিত করে প্রথমে এসব এলাকায় আগে উন্নয়ন করার দাবি জানাই। কারণ আগ থেকেই উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল এসব এলাকা।
কলমে- জুনেদ আহমদ চৌধুরী
উন্নয়নকর্মী, সমাজকর্মী ও সংবাদকর্মী